বোন সম্পর্কে

সন্ত কস্তুরী নিজের সম্পূর্ণ জীবন দিব্য বিভূতি শ্রী বাবুজী মহারাজের (শাজাহান পুরের শ্রী রামচন্দ্রজী মহারাজ) সেবা এবং তার দ্বারা প্রতিপাদিত আধ্যাত্মিক পথ এবং কার্যে উত্সর্গ করেন | তার প্রত্যেক কার্যে, যেমন প্রবচন, সত্সংগ, গীতগায়ন ইত্যাদি এবং শ্রী বাবুজী সম্বন্ধী প্রত্যেকটি কার্যে এক দিব্যতার ঝলক থাকত | তার সান্নিধ্যে এবং তার কার্যে সর্বদাই শ্রী বাবুজী মহারাজের সান্নিধ্যতার বোধ হত |

কস্তুরী দিদি দিব্য প্রেম ও ভক্তির এক জীবন্ত উদাহরণ |শ্রী বাবুজী মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি যে ব্রহ্ম বিদ্যা গ্রহন করেন সে বিদ্যাকে নিজের জীবনে পূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠিত করে দেখান এবং এক অর্বাব্যসায়ী সমর্পিত সাধক রূপে বাকি অভ্যাসীদের (সাধকদের) সেসব শিক্ষা প্রদান করেন |

কস্তুরী দিদি পূজ্য সদ্গুরু শ্রী বাবুজী মহারাজের উপর সম্পূর্ণ আস্থার সহিত সমর্পিত হয়ে নিজের সমগ্র জীবন য়াপন করেন | শ্রী বাবুজী মহারাজ স্বয়ং বলেছিলেন যে সন্ত কস্তুরী তার মধ্যে লায়াবস্থা প্রাপ্ত করে নিয়েছে | আমরা সবাই সন্ত কস্তুরীকে জিজ্জী বলে ডাকতাম যার অর্থ হলো বড়বোন বা বড়দিদি, কিন্তু আমাদের উপর তার স্নেহ ঠিক মায়ের মত ছিল |

এক বার দিদি শ্রী বাবুজীর আগ্রহে নিজের জীবনী নিজেই লিখে শ্রী বাবুজীর পদপ্রান্তে রেখে বলেছিলেন – “আমার বাস্তবিক জীবন তো আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেই সুরু হয়েছে; তাই এই জীবন পরিচয়ের কোন মূল্যই নেই |” তা সত্তেও শ্রী বাবুজী আর দিদির মধ্যে পত্রালাপ, দিদির অধ্যাত্মিক ডায়েরি এবং অন্য প্রকাশনের ওপর আধারিত দিদির এই সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচয় আমাদের এক অতি সামান্য প্রয়াস মাত্র |

সন্ত কস্তুরী দিদির জন্ম ২৬ সে সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ এ (26th September, 1926) (আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের সপ্তমী তিথিতে ) উত্তর প্রদেশের মহারাজনগরের লখিমপুর খীরীতে হয়ে ছিল | তার ঠাকুরদা (দাদা) পণ্ডিত জগন্নাথ প্রাসাদ পুলিশ অধিক্ষক অর্থাত (Superintendent of Police)পদে নিযুক্ত ছিলেন | পণ্ডিত জগন্নাথ প্রাসাদের তিন পুত্র এবং এক কন্যা ছিল | জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম পণ্ডিত রামদাস চতুর্বেদী, দ্বিতীয় পুত্রের নাম পণ্ডিত এম এল চতুর্বেদী এবং কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন পণ্ডিত দয়ানন্দ চতুর্বেদী | শ্রী এম এল চতুর্বেদী এলাহাবাদ উচ্ছ ন্যায়ালয়ে জজ ছিলেন এবং পণ্ডিত দয়ানন্দ চতুর্বেদী অলীগড়ে উকিল ছিলেন | শ্রী রামদাস চতুর্বেদী লখিমপুরে উকিল ছিলেন | পণ্ডিত রামদাস চতুর্বেদীর পাঁচটি কন্যা এবং দুটি পুত্র ছিল | সন্ত কস্তুরী উনার তৃতীয় সন্তান | কস্তুরী দিদির মা শ্রীমতি ভগবতী দেবী এক গৃহকার্যে নিপুণা সুশীল সাধ্বী সুগৃহিনী ছিলেন |

শ্রী বাবুজীর সঙ্গে দেখা হবার পূর্বে কস্তুরী দিদির জীবনে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে | সন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসের এক সন্ধ্যা বেলায় যখন দিদি আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন, সেই সময় হটাৎ তিনি আবিষ্কার করেন যেন আকাশটা আকাশটা অদ্ভুত এক জ্যোতির্ময় আলোতে ভরা এবং সেই আলোর মধে দিদি শ্রী রাম ঠাকুরের মূর্তি দেখতে পান | একটু পরেই শ্রী রাম ঠাকুরের মূর্তিটা বিলীন হয়ে যায় এবং তার জায়গায় শ্রী কৃষ্ণ ঠাকুরের মূর্তির আবির্ভাব হয় | একটু পরেই আবার কৃষ্ণ ঠাকুরের ছবি অন্তর্ধ্যান অন্তধ্যান হয়ে সে খানে ওঙ্কার ( ঔং) দৃষ্টিগোচর হয় | কিন্তু তাও কিছুক্ষনের মধ্যে বিলীন হয়ে মিলিয়ে যায় আকাশে | অতিবিহ্বল অবস্থায় দিদি আকাশ -পানে চেয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পান এক দেদীপ্যমান আলোর মধ্যে একটি দুর্বল কিন্তু তেজোময়, জ্যোতির্ময় গোঁফ-দাড়ি যুক্ত-কায়া | সে কায়ায় অতি মহৎ তেজ বিদ্যমান | দিদি বিস্ফারিত চোখে সে অনুপম দৃশ্য দেখতেই থেকে যান এবং কতক্ষণ সে দিব্যমূর্তি অটল-অনড় ছিল দিদির মনে নেই | এ দৃশ্য দেখতে দেখতে দিদি চৈতন্য হারান | দিদির যখন চৈতন্য ফিরে আসে তখন আকাশ পরিষ্কার | এর পর থেকেই দিদির হৃদয়ে সে দিব্য বিভূতির প্রতীক্ষা চলতে থাকে |

সেই দিনই রাত্রে প্রায় একটা নাগাদ দিদি একটা স্বপ্ন দেখেন যে তিনি নিজের পরিবার সহিত একটি বিশাল কালী বাড়ির মুখ্য দরজায় দাড়িয়ে আছেন এবং দেখছেন যে দ্বারের চৌকাঠে এক দিব্যজ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, যার মুখে শ্বেত লম্বা-দাড়ি ভর্তি, শান্ত-গম্ভীর মুদ্রায় দাড়িয়ে আছেন | সেই মহাপুরুষ দিদির হাতে একখানি তলোয়ার দিয়ে বললেন – ‘এই তলোয়ার দিয়ে নিজের মস্তক কেটে আমার হাতে দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করো; এটাই নিয়ম | দিদি অবিলম্বে মহাপুরুষের দেওয়া সেই তলোয়ার দিয়ে নিজের মস্তক ছেদ করে তার হাতে দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলেন কিন্তু সেখানে কোন মূর্তি বা বিগ্রহ ছিল না | সে খানে এক অলোকিক পরিবেশ ছিল এবং দিদির অবস্থাও দিব্য ছিল | স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল | কিন্তু জাগা অবস্থাতেও দিদির চোখের সামনে স্বপ্নে দেখা সেই অনুপম দৃশ্য বারম্বার ভেসে আসত |

তার পরের দিন, অর্থাৎ তারিখ ৩ জানুয়ারী ১৯৪৮ দিদির জন্য এক আশ্চর্য ঘটনা প্রতীক্ষা করছিল | সেদিন শ্রী বাবুজী মহারাজ তার বাড়িতে পদার্পণ করেন | শ্রী বাবুজী মহারাজের প্রতক্ষ্য দর্শন করে দিদি আস্চার্যচকিত হয়ে যান; কারণ বাবুজী মহারাজেই সেই মহাপুরুষ ছিলেন যাকে দিদি আগের দিন রাতে স্বপ্নে দেখে ছিলেন | এই ভাবে এক সদ্গুরুকে পাবার মনোবাঞ্ছা দিদির পূর্ণ হয | দিদি গুরুকে সামনে দেখে বলে উঠলেন -” আরে ! বাবুজী আপনি! আমি কবে থেকে আপনার দর্শানাভিলাসী ছিলাম | আজ আমার অভিলাসা পূর্ণ হলো |” শ্রী বাবুজিও ভাব-বিভোর হয়ে বললেন – “আমিও তো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম মা (বিটিয়া), এতদিন পর্ আজকে পেলাম | এই ভাবে শ্রী বাবুজী মহারাজ ও দিদির প্রথম মিলনের সম্বাদ শুরু হয় | সাধারণত: শিষ্যই গুরুর নিকট যায়, কিন্তু এ খানে সদ্গুরু নিজেই বিশিষ্ট শিষ্যের আকর্ষনে তার বাড়িতে পদার্পণ করেন, তার দ্বারস্থ হন | সন্ত কস্তুরীর আধ্যাত্মিক যাত্রা এই ভাবে শুরু হয় | কস্তুরী দিদি নিজের আধ্যাত্মিক অনুভূতি পাত্রের দ্বারা শ্রী বাবুজী মহারাজের নিকট নিবেদন করতেন | শ্রী বাবুজী মহারাজও পত্রের দ্বারা দিদির পথ দর্শন করতেন
|

শ্রী বাবুজী ও কস্তুরী দিদির মধ্যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রসঙ্গে যে সব পত্র আদান-প্রদান হয়ে ছিল তার সংকলন মানব মাত্রের জন্য ‘অনন্ত যাত্রা’ নামক গ্রন্থে পাঁচটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে | এর অতিরিক্ত কস্তুরী দিদি আরো কযেকটা পুস্তক লিখেছেন | এই সমস্ত পুস্তক দিদির কঠোর সাধনার প্রতিফল এবং শ্রী বাবুজীর কৃপায় গ্রহিত আধ্যাত্মিক অনুভবের (অনুভূতির) উপরে আধারিত |

শ্রী বাবুজী মহারাজের সহিত গুরু শিষ্যা সম্পর্ক হবার সময় থেকেই বাবুজীর নেতৃত্বে কস্তুরী দিদির আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু হয়ে যায় | দিদি শীঘ্রই বুঝতে পারেন যে শ্রী বাবুজী মহারাজই সেই দিব্য বিভূতি যার অবতরণ সম্পূর্ণ মানবতার উদ্ধারের জন্য প্রকৃতির অনুরোধে হয়েছে | ৭ ই নভেম্বর ১৯৪৯ সালে শ্রী বাবুজী মহারাজ কস্তুরী দিদিকে অন্যান্য অধ্যবসায়ীদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেবার জন্য প্রশিক্ষক (Preceptor) নিযুক্ত করেন এবং সেই কাজ শ্রী বাবুজীকে সমর্পিত করে দিদি আজীবন নিষ্ঠার সহিত করে যান | এ ছাড়া দিদি শ্রী বাবুজীর আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে শ্রী বাবুজীর আদেশে প্রকৃতির অনেক মহৎ কার্যও সম্পন্ন করেন |

২৭ এ অক্টোবর ১৯৫৩ সালে শ্রী বাবুজী মহারাজ কস্তুরী দিদিকে সন্ত গতি (condition of a saint in spirituality) প্রদান করেন, ‘সন্ত’ উপাধিতে বিভূষিত করেন এবং দিদিকে সন্ত বলে সম্বোধিত করেন | সেই সময় থেকেই কস্তুরী দিদি ‘সন্ত কস্তুরী’ নামে বিখ্যাত হন | ২৯ সে আগষ্ট ১৯৫৫ সালে শ্রী বাবুজী মহারাজ সন্ত কস্তুরীকে চিঠির মাধ্যমে বলেন – “তুমি আমার মধ্যে পূর্ণ লয়াবস্থা প্রাপ্ত করেছ, তুমি আর আগের কস্তুরী নও যাকে তোমার বাবা-মা জন্ম দিয়েছিলেন |” ১৫ ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে শ্রী বাবুজী মহারাজ কস্তুরী দিদিকে লেখেন – ” তুমি ঈশ্বরীয় দশা লাভ করেনিয়েছ |” ১৫ ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে দিদি কেন্দ্রীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ পান | ২৮ সে জুন ১৯৬৮ সালে দিদি ব্লিসের (bliss)অবস্থায় প্রবেশ করেন | দিদি ২.৫.১৯৭৫ তিথিতে শ্রী বাবুজী মহারাজকে চিঠির মাধ্যমে অবগত কারণ – ” আমার অনুভব হচ্ছে যে কেও আমাকে অনন্ত সাগর পার করিয়ে দিয়েছে |”

শ্রী বাবুজী মহারাজ কস্তুরী দিদির উপরে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান করে ছিলেন. এক বার শ্রী বাবুজী মহারাজ দিদিকে বলে ছিলেন যে, তুমি নিজের আধ্যত্মিক অনুভবগুলি মানবমাত্রের কল্যানে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশিত কর | শ্রী বাবুজী মহারাজের এই অনুরোধকে আদেশরূপে গ্রহন করে কস্তুরী দিদি অত:পর তার আধ্যাত্মিক অনুভবের ভান্ডারকে লিপিবদ্ধ করতে নিজের লেখনীকে বিরাম দেন নি | তার বাণীতে দৈবিক ধারা প্রবাহিত হত যা তার প্রবচন এবং গীত গায়নের মাধ্যমে অনুভূত হয় | দিদির গীত আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং দৈবিক প্রানাহুতিতে (spiritual transmission) পরিপূর্ণ | তার লেখা গীত ‘সন্ধ্যাগীত’ নামক পুস্তক দুই ভাগে প্রকাশিত হয়েছে এবং তার আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও লেখ ‘অনুভবসরিতা’ নামে প্রকাশিত হয় | নিজের জীবনকে সাধকদের পথপ্রদর্শনে সমর্পিত করার সাথে-সাথে কস্তুরী দিদি সাধকদের সাহায্যের জন্য প্রশিক্ষকও (preceptor) নিযুক্ত করেন |

কস্তুরী দিদির উপস্থিতিতে এবং তার সর্বকার্য়ে শ্রী বাবুজী মহারাজের উপস্থিতির অনুভব হত | দিদির আধ্যাত্মিক অবস্থা এরকম ছিল যে, প্রায় ‘এ খানে বসে সে খানে থাকার’ বোধ হত | অর্থাত দিদি সশরীরে পৃথিবীতে থেকেও এবং ইহলৌকিক কার্যে ব্যস্ত থাকা সত্তে ও নিরন্তর দৈবিক দশায় লীন থাকতেন | যে প্রকারে শ্রী বাবুজী মহারাজ নিজের মধ্য দিয়ে সমর্থ সদ্গুরু শ্রী লালাজী মহারাজের জীবন্ত উদাহরণ প্রস্তুত করেন, ঠিক সেই রুপে কস্তুরী দিদিও নিজের সদ্গুরু শ্রী বাবুজী মহারাজের সজীব দৃষ্টান্ত ছিলেন |

দিদি নিজের একটি গানে লিখেছেন:-
” ও বাবুজী জো তেরে চরনৌ মে আ গয়ে,
আধ্যাত্ম পথ পর জলতী মশাল পা গয়ে |”

এর মানে হলো – ‘ও বাবুজী যারা তোমার সরণে এসে গেছে, তারা আধ্যাত্মিক পথের প্রকাশ বা আলো, পেয়ে গেছে.’

কস্তুরী দিদি তার আর একটি গানে লিখেছেন :-

” তন কি মাটি মে মেরে বৃক্ষ জব উগেগা কোই,
পাতি পাতি মে তেরা নাম পড় সকেগা কোই,
ভক্তি কে রস সে সব কে মণ পুলক সে জায়েঙ্গে | ”

অর্থাত – ‘ আমার সরীরের মাটিতে যখন কোনো গাছ জন্ম নেবে, তার পাতায়-পাতায় বাবুজী তোমার নাম লেখা থাকবে, আর এই দেখে সবার মন ভক্তি রসে প্রফুল্লিত হয়ে উঠবে |’

এই রকম ছিল শ্রী বাবুজীর প্রতি কস্তুরী দিদির ভক্তি ও লয়াবস্থা !